অ্যামেরিকান ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একঃ ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের সাথে বঙ্গবন্ধুর কী আলাপ হয়েছিল?
পূর্ব পাকিস্তানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালেই বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসায় দেখা করতে এসেছিলেন। সেখানে এক ঘণ্টাব্যাপী আন্তরিক পরিবেশে ফারল্যান্ডের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলাপ হয়। ফারল্যান্ড সেদিনই ওয়াশিংটনে এই মিটিং এর বিস্তারিত জানিয়ে তারবার্তা পাঠান। কী ছিল সেই তারবার্তায়? আসুন ফারল্যান্ডের বয়ানেই শুনি সেই মিটিংয়ের খুঁটিনাটি। এটা সেক্রেটারি অব স্টেটকে পাঠানো রাষ্ট্রদূতের বার্তা:
১। ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ সকাল নয়টায় আমি শেখ মুজিবরের সাথে তার ঢাকার বাসভবনে দেখা করতে যাই। তিনি গাড়িতেই আমাকে রিসিভ করেন এবং তার বাসা পর্যন্ত আমাকে নিয়ে যান। এটা খুবই স্পষ্ট ছিল যে তিনি আমাকে দেখে খুশি হয়েছেন এবং আমাকে দারুণ আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানান।সামাজিক কুশলাদি বিনিময়ের পরে মূল আলাপ শুরু হল। সামাজিক কুশলাদির মধ্যে তার এই বক্তব্যও ছিল যে, “আমাদের এই মিটিংটা হচ্ছে পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে।” আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী অবস্থা মনে হচ্ছে আপনার?” এই কথা বলে তিনি সরাসরি মূল আলোচনায় প্রবেশ করলেন। আমি উনাকে বললাম, একজন কৌতুহলী দর্শক হিসেবে সব ঘরানার সংবাদপত্র থেকে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিয়ে যে সংবাদ দেখি তাতে আমি উদ্বিগ্ন। তবে আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে আপনিই বরং বর্তমান অবস্থার পর্যালোচনা ভালোভাবে করতেপারবেন। আপনার কাছে থেকে সেটা শুনতে চাওয়াটাই বেশি সঙ্গত।
২। শেখ মুজিব বললেন, তাঁর মতে, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা একমাত্র ভুট্টোর কুমন্ত্রণার কারণে হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন না। বরং ভুট্টো এমন একটা অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করছেন, যা তৈরি হয়েছে সেইসব মানুষদের দ্বারা যারা আইয়ুবকে সমর্থন করেছিল। তিনি বলেন, ভুট্টো সম্ভবত নিজের ইচ্ছায় চলছেন না। কারণ তার যথেষ্ট সংগঠিত কোনও রাজনৈতিক দল নেই। পশ্চিম পাকিস্তানি কিছু সামরিক অফিসারের সাহায্য এবং নেতৃত্ব ছাড়া ভুট্টো অচল। ঠিক এই কারণেই ভুট্টো সামরিক প্রস্তুতির জন্য মাত্রাতিরিক্ত খরচ করার পক্ষে।
৩। ভুট্টো অধিবেশনে যোগ দেবেন কি-না আমার এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, তিনি মনে করেন ভুট্টো অধিবেশনে যোগ দেবেন। কারণ আওয়ামী লীগ ভুট্টোকে তার ভাষায় “চেপে ধরেছে” বলে মনে করেন তিনি। যদিও তিনি বললেন, তিনি অনুমান করছেন ভুট্টো যাকে তিনি “হাদা গরু” বলে অভিহিত করেন, সেই ভুট্টো তার দলের লোকদের খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষেই নিয়ে যাবেন। সেই সময় থেকেই বাংলাদেশের জীবন সংগ্রাম শুরু হবে।
৪। আমি তখন তাকে জিজ্ঞেস করলা, পিপিপি এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থানের দূরত্ব কতটুকু? তিনি বললেন, বিশাল দূরত্ব এবং এই দূরত্ব এতই বিশাল যে যে কোনও মতৈক্যে আসা রীতিমতো অসম্ভব। আরো বিশেষ করে বলতে গেলে আওয়ামী লীগ এবং সেই দলের নির্বাচিত নেতা হিসেবে তিনি ছয় দফা প্রশ্নে কোন আপোষ করবেন না এবং আপোষ করতে পারেন না। এই ছয় দফাকে তিনি প্রায় এক দশক ধরে নিজের জীবনের অংশ করে নিয়েছেন। তিনি বললেন, ভুট্টো চায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী হতে এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে মনোনীত করার অধিকার পেতে। শেখ মুজিব বললেন, ভুট্টোর পররাষ্ট্র নীতি তার মতে যাচ্ছেতাই । ভুট্টোর কমিউনিস্ট চিনের প্রতি রয়েছে প্রবল অনুরাগ এবং ভারতের প্রসঙ্গে সে একরোখা। শেখ মুজিব এরপরে তার কমিউনিস্ট বিরোধী অবস্থানের কথা দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাখ্যা করলেন এবং বললেন চিন এই অঞ্চলের জন্য কী বিপদ সৃষ্টি করছে। ভারত প্রশ্নে তিনি মনে করেন ভারতের সাথে বাংলাদেশের অবশ্যই ঐতিহাসিক ভালো সম্পর্ক পুনস্থাপন করা দরকার এবং আগের বাণিজ্য রুটগুলো চালু করা দরকার। তিনি এই মত দিলেন ভুট্টো যা চায় এবং বাংলাদেশের মানুষ যা দাবি করে এই দুই বিষয়ের পার্থক্য অনতিক্রম্য।
৫। এরপরে তিনি পাকা ১০ মিনিটের একটা ভাষণ দিলেন, যা তার রাজনৈতিক বক্তৃতার অংশ হতে পারতো। তিনি বললেন, “তার দেশের” জনগণ তার পিছনে আছে, তিনি অল্প কিছু ছোট ছোট হার্ডকোর কমিউনিস্টদের দৌড়ের উপর রেখেছেন। ভাসানীর ছত্রভঙ্গ অবস্থা দেখে তা বুঝা যাচ্ছে। তিনি বললেন, কমিউনিস্টরা তার দলের তিনজন নেতাকে খুন করেছে। তিনিও পাল্টা প্রতিজ্ঞা করেছেন, প্রত্যেক নিহত আওয়ামী লীগ নেতার জন্য কমিউনিস্টদের তিনজনকে খুন করবেন এবং “এইটাই আমরা করেছি”। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্বের হাতে তিনি যে কয়দিন জেলে কাটিয়েছেন সেটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি ঐক্য রক্ষা করা নাই যায় তবে “বুলেটের মুখে দাঁড়াতে” তার কোনও ভয় থাকবে না। তিনি নাটকীয়ভাবে বলে উঠলেন, তিনি জেলের ভয়ে ভীত নন, এমনকি তাকে “টুকরো টুকরো করে ফেললেও” জনগণের দেয়া ম্যান্ডেট থেকে তিনি বিচ্যুত হবেন না। তিনি স্বগোতোক্তির মত বলতে থাকলেন, তিনি বিচ্ছিন্ন হতে চাননি, বরং তিনি চেয়েছিলেন, পাকিস্তানের সাথে এমন একটি কনফেডারেশন, যেখানে বাংলাদেশের জনগণ বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ২০% নয় বরং একটা ন্যায্য হিস্যা পাবে। যেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ৬০% আসে সে অংশকে কীভাবে ইসলামাবাদ ভিখিরির মতো এই সামান্য ভাগ ছুঁড়ে দেয়?
৬। বৈদেশিক সাহায্যের প্রশ্নে শেখ সাহেব বললেন, পাকিস্তান এই মুহূর্তে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এর ভয়াবহ সংকটে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কার্যত শূণ্য। এইটা অবশ্য বাংলাদেশের জন্য শাপেবর হয়েছে। কারণ তার দলকে বশে আনার জন্য আর্থিক সঙ্গতি পশ্চিম পাকিস্তানের নাই। তিনি আরো বললেন, “পশ্চিম পাকিস্তান জাপানের কাছে একটা বড় ধরনের সাহায্য চাচ্ছে, সেটা যদি তারা পেয়ে যায় তবে তারা আমাদের অবস্থা খারাপ করে দিবে।” সেই মুহূর্তে তিনি স্পষ্টতই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,আমেরিকা এবং কনসোর্টিয়াম কি বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সাহায্য করবে? আমি তাকে বললাম, একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি নিশ্চয় জানেন আমেরিকা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আগ্রহী। তবে আমাদের এবং কনসোর্টিয়ামের আর্থিক সাহায্যের বিষয়ে দুইটা সীমাবদ্ধতা আছে
১/ আর্থিক সাহায্যের জন্য যেই ফান্ড এখন আছে তা আগের তুলনায় সীমিত।
২/ আর্থিক সাহায্যের প্রজেক্টগুলো সতর্কতার সাথে তৈরি করা হয় এবং মনিটর করা হয়। বিশেষ জোর দেয়া হয় সাহায্যগ্রহীতা দেশের জনশক্তির ও সরকারি কর্মকর্তাদের ফান্ডের ব্যবহারের বিষয়ে দক্ষতা জ্ঞান এবং প্রকল্পের প্রশাসনিক দিক সামলানোর ক্ষমতার উপরে।
আমি বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য ফান্ডের অপ্রতুল ব্যবহার এবং দক্ষ জনশক্তির অভাবের বিষয়ে আমার উদ্বেগের কথা তাঁকে জানালাম।
৭। এরপরে শেখ মুজিব দীর্ঘ সময় নিয়ে জানালেন কেন পূর্ব পাকিস্তান একটা টেকসই অঞ্চল হিসেবে দাঁড়াতে পারে। তিনি গ্যাসের বিশাল রিজার্ভের কথা জানালেন, যা শুধু একটা পেট্রো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির জন্য স্থানীয় ভাবেই ব্যবহার করা যাবে তাই নয় বরং ভারতেও রপ্তানি করা যাবে। তিনি বললেন, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দুই বছরের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। বোরো ধান চাষাবাদ হবে তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয়। আমি যখন পূর্ব পাকিস্তানের অবিশ্বাস্য জন্মহারের কথা মনে করিয়ে দিলাম, তখন তিনি বললেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ তার প্রধান লক্ষ্য হবে। আজকে যেভাবে পরিবার ছোট করার জন্য চাপ দিতে হচ্ছে, সেটা না করেই তিনি মানুষকে পরিবার ছোট রাখার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করতে পারবেন।
৮। খুব সিরিয়াস মুডে শেখ মুজিব বললেন, যদিও তিনি বলতে চাচ্ছিলেন না, তবুও তার বলা উচিত যে আমেরিকার একটা বদনাম আছে যে সে মতের অমিল হলেই তার বন্ধুকে ত্যাগ করে। তিনি মনে করেন, এই অঞ্চল নিয়ে মতের অমিল হবেই, তখন আমেরিকা সত্যিকারের পরীক্ষায় পড়বে। আমি শেখ মুজিবকে বললাম যে আমি মনে করি তার বক্তব্যটা খুবই যুক্তিযুক্ত, তবে আমেরিকার তার বন্ধুদের সাহায্যের জন্য কোন ভূমিকা নেয় সে বিষয়ে আরেকদিন আলাপ করবো। আমি আরো যুক্ত করলাম আমরা এই বিশ্বাস থেকেই পাকিস্তানকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি দিয়ে সাহায্য করেছি। শেখ সাহেবের চতুর উত্তর ছিল, আমাকে যদি আমেরিকা এক বিলিয়ন ডলার দিত, আমি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আর গণতন্ত্রের শক্ত দেয়াল তৈরি করতাম।
৯। এই সব আলাপের পিছনে শেখ সাহেব যা প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন তা হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রতি অ্যামেরিকান নীতি কী? সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে আমি অ্যামেরিকান নীতি যা স্টেট ৩৫৫৩৪ এ উদ্ধৃত আছে তা ব্যাখ্যা করলাম। এবং আমি এমনভাবে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা তুললাম না যেন কোনও অবস্থাতেই মনে না হয় যে বাঙালিদের আশা আকাঙ্ক্ষার পক্ষে অ্যামেরিকান অবস্থান পরিবর্তণীয় নয়। আমি যদিও এটা বলতে ভুললাম না যে, বৈদেশিক সাহায্য প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ ভাণ্ডার নয়, যা থেকে অসীম আর্থিক সাহায্য পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধানের জন্য বেরিয়ে আসবে। এরপরে শেখ সাহেব প্রশ্নের আকারে না বলে বললেন, বাংলাদেশের সকল বন্ধুদের উচিত তাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তাদের নিরস্ত করার, যারা অস্ত্রের শক্তি ব্যবহার করে আমার “দেশের জনগণকে উপনিবেশিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে চায়”। তিনি বললেন, তিনি দীর্ঘসময় ধরে বিশ্ব রাজনীতির ছাত্র হিসেবে এটা জানেন যে আমেরিকা এবং অন্যান্য সাহায্যদাতা দেশগুলোর পশ্চিম পাকিস্তানকে এই ধরনের চাপ দেয়ার ক্ষমতা আছে, যদি তারা সেটা চায়। যেহেতু কোনও প্রশ্ন করা হয়নি তাই তার উত্তর দেয়া থেকে আমি বিরত থাকলাম। তবে এই কথার একটা উত্তর দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে, আমরা যা প্রত্যাশা করি তার আগেই। তাই এ নিয়ে সিরিয়াসভাবে ভাবা দরকার। আমি ধারণা করেছিলাম শেখ সাহেব স্বীকৃতির প্রসঙ্গটা তুলবেন, যেহেতু তিনি এই বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন বলে আমার মনে হয়েছিল যা আমি রিপোর্টে উল্লেখ করেছি, কিন্তু তিনি তা করেননি।
আমি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার সাথে আবার কথা বলবো এই আশাবাদ ব্যক্ত করলাম। যেহেতু এখন পর্যন্ত অনেক বিষয়ই অপরিষ্কার আছে, যা সামনের সময়গুলোতে পরিষ্কার হবে। তিনি বললেন, তিনি আজকের মিটিংটার জন্য আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করেছিলেন এবং যেকোন সময়ে পরবর্তী মিটিং-এ বসতে পারলে খুশি হবেন। এছাড়াও তিনি শুধু আমার সাথে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কথাই নিশ্চিত করলেন না, তিনি বাংলাদেশ ও আমেরিকার জনগণের বন্ধুত্বের কথাও নিশ্চিত করলেন। এই আলোচনাটা এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় ধরে আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে চলে এবং শেখ মুজিব আমাকে তার অনুরক্ত সমর্থকদের মধ্যে দিয়ে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন।
সূত্রঃ Source: National Archives, RG 59, Central Files 1970–73, POL PAK–US. Confidential; Priority; Limdis. Repeated to Islamabad, Karachi, and Lahore.
পূর্ব পাকিস্তানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালেই বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসায় দেখা করতে এসেছিলেন। সেখানে এক ঘণ্টাব্যাপী আন্তরিক পরিবেশে ফারল্যান্ডের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলাপ হয়। ফারল্যান্ড সেদিনই ওয়াশিংটনে এই মিটিং এর বিস্তারিত জানিয়ে তারবার্তা পাঠান। কী ছিল সেই তারবার্তায়? আসুন ফারল্যান্ডের বয়ানেই শুনি সেই মিটিংয়ের খুঁটিনাটি। এটা সেক্রেটারি অব স্টেটকে পাঠানো রাষ্ট্রদূতের বার্তা:
১। ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ সকাল নয়টায় আমি শেখ মুজিবরের সাথে তার ঢাকার বাসভবনে দেখা করতে যাই। তিনি গাড়িতেই আমাকে রিসিভ করেন এবং তার বাসা পর্যন্ত আমাকে নিয়ে যান। এটা খুবই স্পষ্ট ছিল যে তিনি আমাকে দেখে খুশি হয়েছেন এবং আমাকে দারুণ আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানান।সামাজিক কুশলাদি বিনিময়ের পরে মূল আলাপ শুরু হল। সামাজিক কুশলাদির মধ্যে তার এই বক্তব্যও ছিল যে, “আমাদের এই মিটিংটা হচ্ছে পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে।” আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী অবস্থা মনে হচ্ছে আপনার?” এই কথা বলে তিনি সরাসরি মূল আলোচনায় প্রবেশ করলেন। আমি উনাকে বললাম, একজন কৌতুহলী দর্শক হিসেবে সব ঘরানার সংবাদপত্র থেকে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিয়ে যে সংবাদ দেখি তাতে আমি উদ্বিগ্ন। তবে আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে আপনিই বরং বর্তমান অবস্থার পর্যালোচনা ভালোভাবে করতেপারবেন। আপনার কাছে থেকে সেটা শুনতে চাওয়াটাই বেশি সঙ্গত।
২। শেখ মুজিব বললেন, তাঁর মতে, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা একমাত্র ভুট্টোর কুমন্ত্রণার কারণে হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন না। বরং ভুট্টো এমন একটা অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করছেন, যা তৈরি হয়েছে সেইসব মানুষদের দ্বারা যারা আইয়ুবকে সমর্থন করেছিল। তিনি বলেন, ভুট্টো সম্ভবত নিজের ইচ্ছায় চলছেন না। কারণ তার যথেষ্ট সংগঠিত কোনও রাজনৈতিক দল নেই। পশ্চিম পাকিস্তানি কিছু সামরিক অফিসারের সাহায্য এবং নেতৃত্ব ছাড়া ভুট্টো অচল। ঠিক এই কারণেই ভুট্টো সামরিক প্রস্তুতির জন্য মাত্রাতিরিক্ত খরচ করার পক্ষে।
৩। ভুট্টো অধিবেশনে যোগ দেবেন কি-না আমার এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, তিনি মনে করেন ভুট্টো অধিবেশনে যোগ দেবেন। কারণ আওয়ামী লীগ ভুট্টোকে তার ভাষায় “চেপে ধরেছে” বলে মনে করেন তিনি। যদিও তিনি বললেন, তিনি অনুমান করছেন ভুট্টো যাকে তিনি “হাদা গরু” বলে অভিহিত করেন, সেই ভুট্টো তার দলের লোকদের খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষেই নিয়ে যাবেন। সেই সময় থেকেই বাংলাদেশের জীবন সংগ্রাম শুরু হবে।
৪। আমি তখন তাকে জিজ্ঞেস করলা, পিপিপি এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থানের দূরত্ব কতটুকু? তিনি বললেন, বিশাল দূরত্ব এবং এই দূরত্ব এতই বিশাল যে যে কোনও মতৈক্যে আসা রীতিমতো অসম্ভব। আরো বিশেষ করে বলতে গেলে আওয়ামী লীগ এবং সেই দলের নির্বাচিত নেতা হিসেবে তিনি ছয় দফা প্রশ্নে কোন আপোষ করবেন না এবং আপোষ করতে পারেন না। এই ছয় দফাকে তিনি প্রায় এক দশক ধরে নিজের জীবনের অংশ করে নিয়েছেন। তিনি বললেন, ভুট্টো চায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী হতে এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে মনোনীত করার অধিকার পেতে। শেখ মুজিব বললেন, ভুট্টোর পররাষ্ট্র নীতি তার মতে যাচ্ছেতাই । ভুট্টোর কমিউনিস্ট চিনের প্রতি রয়েছে প্রবল অনুরাগ এবং ভারতের প্রসঙ্গে সে একরোখা। শেখ মুজিব এরপরে তার কমিউনিস্ট বিরোধী অবস্থানের কথা দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাখ্যা করলেন এবং বললেন চিন এই অঞ্চলের জন্য কী বিপদ সৃষ্টি করছে। ভারত প্রশ্নে তিনি মনে করেন ভারতের সাথে বাংলাদেশের অবশ্যই ঐতিহাসিক ভালো সম্পর্ক পুনস্থাপন করা দরকার এবং আগের বাণিজ্য রুটগুলো চালু করা দরকার। তিনি এই মত দিলেন ভুট্টো যা চায় এবং বাংলাদেশের মানুষ যা দাবি করে এই দুই বিষয়ের পার্থক্য অনতিক্রম্য।
৫। এরপরে তিনি পাকা ১০ মিনিটের একটা ভাষণ দিলেন, যা তার রাজনৈতিক বক্তৃতার অংশ হতে পারতো। তিনি বললেন, “তার দেশের” জনগণ তার পিছনে আছে, তিনি অল্প কিছু ছোট ছোট হার্ডকোর কমিউনিস্টদের দৌড়ের উপর রেখেছেন। ভাসানীর ছত্রভঙ্গ অবস্থা দেখে তা বুঝা যাচ্ছে। তিনি বললেন, কমিউনিস্টরা তার দলের তিনজন নেতাকে খুন করেছে। তিনিও পাল্টা প্রতিজ্ঞা করেছেন, প্রত্যেক নিহত আওয়ামী লীগ নেতার জন্য কমিউনিস্টদের তিনজনকে খুন করবেন এবং “এইটাই আমরা করেছি”। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্বের হাতে তিনি যে কয়দিন জেলে কাটিয়েছেন সেটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি ঐক্য রক্ষা করা নাই যায় তবে “বুলেটের মুখে দাঁড়াতে” তার কোনও ভয় থাকবে না। তিনি নাটকীয়ভাবে বলে উঠলেন, তিনি জেলের ভয়ে ভীত নন, এমনকি তাকে “টুকরো টুকরো করে ফেললেও” জনগণের দেয়া ম্যান্ডেট থেকে তিনি বিচ্যুত হবেন না। তিনি স্বগোতোক্তির মত বলতে থাকলেন, তিনি বিচ্ছিন্ন হতে চাননি, বরং তিনি চেয়েছিলেন, পাকিস্তানের সাথে এমন একটি কনফেডারেশন, যেখানে বাংলাদেশের জনগণ বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ২০% নয় বরং একটা ন্যায্য হিস্যা পাবে। যেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ৬০% আসে সে অংশকে কীভাবে ইসলামাবাদ ভিখিরির মতো এই সামান্য ভাগ ছুঁড়ে দেয়?
৬। বৈদেশিক সাহায্যের প্রশ্নে শেখ সাহেব বললেন, পাকিস্তান এই মুহূর্তে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এর ভয়াবহ সংকটে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কার্যত শূণ্য। এইটা অবশ্য বাংলাদেশের জন্য শাপেবর হয়েছে। কারণ তার দলকে বশে আনার জন্য আর্থিক সঙ্গতি পশ্চিম পাকিস্তানের নাই। তিনি আরো বললেন, “পশ্চিম পাকিস্তান জাপানের কাছে একটা বড় ধরনের সাহায্য চাচ্ছে, সেটা যদি তারা পেয়ে যায় তবে তারা আমাদের অবস্থা খারাপ করে দিবে।” সেই মুহূর্তে তিনি স্পষ্টতই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,আমেরিকা এবং কনসোর্টিয়াম কি বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সাহায্য করবে? আমি তাকে বললাম, একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি নিশ্চয় জানেন আমেরিকা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আগ্রহী। তবে আমাদের এবং কনসোর্টিয়ামের আর্থিক সাহায্যের বিষয়ে দুইটা সীমাবদ্ধতা আছে
১/ আর্থিক সাহায্যের জন্য যেই ফান্ড এখন আছে তা আগের তুলনায় সীমিত।
২/ আর্থিক সাহায্যের প্রজেক্টগুলো সতর্কতার সাথে তৈরি করা হয় এবং মনিটর করা হয়। বিশেষ জোর দেয়া হয় সাহায্যগ্রহীতা দেশের জনশক্তির ও সরকারি কর্মকর্তাদের ফান্ডের ব্যবহারের বিষয়ে দক্ষতা জ্ঞান এবং প্রকল্পের প্রশাসনিক দিক সামলানোর ক্ষমতার উপরে।
আমি বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য ফান্ডের অপ্রতুল ব্যবহার এবং দক্ষ জনশক্তির অভাবের বিষয়ে আমার উদ্বেগের কথা তাঁকে জানালাম।
৭। এরপরে শেখ মুজিব দীর্ঘ সময় নিয়ে জানালেন কেন পূর্ব পাকিস্তান একটা টেকসই অঞ্চল হিসেবে দাঁড়াতে পারে। তিনি গ্যাসের বিশাল রিজার্ভের কথা জানালেন, যা শুধু একটা পেট্রো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির জন্য স্থানীয় ভাবেই ব্যবহার করা যাবে তাই নয় বরং ভারতেও রপ্তানি করা যাবে। তিনি বললেন, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দুই বছরের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। বোরো ধান চাষাবাদ হবে তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয়। আমি যখন পূর্ব পাকিস্তানের অবিশ্বাস্য জন্মহারের কথা মনে করিয়ে দিলাম, তখন তিনি বললেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ তার প্রধান লক্ষ্য হবে। আজকে যেভাবে পরিবার ছোট করার জন্য চাপ দিতে হচ্ছে, সেটা না করেই তিনি মানুষকে পরিবার ছোট রাখার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করতে পারবেন।
৮। খুব সিরিয়াস মুডে শেখ মুজিব বললেন, যদিও তিনি বলতে চাচ্ছিলেন না, তবুও তার বলা উচিত যে আমেরিকার একটা বদনাম আছে যে সে মতের অমিল হলেই তার বন্ধুকে ত্যাগ করে। তিনি মনে করেন, এই অঞ্চল নিয়ে মতের অমিল হবেই, তখন আমেরিকা সত্যিকারের পরীক্ষায় পড়বে। আমি শেখ মুজিবকে বললাম যে আমি মনে করি তার বক্তব্যটা খুবই যুক্তিযুক্ত, তবে আমেরিকার তার বন্ধুদের সাহায্যের জন্য কোন ভূমিকা নেয় সে বিষয়ে আরেকদিন আলাপ করবো। আমি আরো যুক্ত করলাম আমরা এই বিশ্বাস থেকেই পাকিস্তানকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি দিয়ে সাহায্য করেছি। শেখ সাহেবের চতুর উত্তর ছিল, আমাকে যদি আমেরিকা এক বিলিয়ন ডলার দিত, আমি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আর গণতন্ত্রের শক্ত দেয়াল তৈরি করতাম।
৯। এই সব আলাপের পিছনে শেখ সাহেব যা প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন তা হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রতি অ্যামেরিকান নীতি কী? সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে আমি অ্যামেরিকান নীতি যা স্টেট ৩৫৫৩৪ এ উদ্ধৃত আছে তা ব্যাখ্যা করলাম। এবং আমি এমনভাবে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা তুললাম না যেন কোনও অবস্থাতেই মনে না হয় যে বাঙালিদের আশা আকাঙ্ক্ষার পক্ষে অ্যামেরিকান অবস্থান পরিবর্তণীয় নয়। আমি যদিও এটা বলতে ভুললাম না যে, বৈদেশিক সাহায্য প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ ভাণ্ডার নয়, যা থেকে অসীম আর্থিক সাহায্য পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধানের জন্য বেরিয়ে আসবে। এরপরে শেখ সাহেব প্রশ্নের আকারে না বলে বললেন, বাংলাদেশের সকল বন্ধুদের উচিত তাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তাদের নিরস্ত করার, যারা অস্ত্রের শক্তি ব্যবহার করে আমার “দেশের জনগণকে উপনিবেশিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে চায়”। তিনি বললেন, তিনি দীর্ঘসময় ধরে বিশ্ব রাজনীতির ছাত্র হিসেবে এটা জানেন যে আমেরিকা এবং অন্যান্য সাহায্যদাতা দেশগুলোর পশ্চিম পাকিস্তানকে এই ধরনের চাপ দেয়ার ক্ষমতা আছে, যদি তারা সেটা চায়। যেহেতু কোনও প্রশ্ন করা হয়নি তাই তার উত্তর দেয়া থেকে আমি বিরত থাকলাম। তবে এই কথার একটা উত্তর দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে, আমরা যা প্রত্যাশা করি তার আগেই। তাই এ নিয়ে সিরিয়াসভাবে ভাবা দরকার। আমি ধারণা করেছিলাম শেখ সাহেব স্বীকৃতির প্রসঙ্গটা তুলবেন, যেহেতু তিনি এই বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন বলে আমার মনে হয়েছিল যা আমি রিপোর্টে উল্লেখ করেছি, কিন্তু তিনি তা করেননি।
আমি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার সাথে আবার কথা বলবো এই আশাবাদ ব্যক্ত করলাম। যেহেতু এখন পর্যন্ত অনেক বিষয়ই অপরিষ্কার আছে, যা সামনের সময়গুলোতে পরিষ্কার হবে। তিনি বললেন, তিনি আজকের মিটিংটার জন্য আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করেছিলেন এবং যেকোন সময়ে পরবর্তী মিটিং-এ বসতে পারলে খুশি হবেন। এছাড়াও তিনি শুধু আমার সাথে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কথাই নিশ্চিত করলেন না, তিনি বাংলাদেশ ও আমেরিকার জনগণের বন্ধুত্বের কথাও নিশ্চিত করলেন। এই আলোচনাটা এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় ধরে আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে চলে এবং শেখ মুজিব আমাকে তার অনুরক্ত সমর্থকদের মধ্যে দিয়ে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন।
সূত্রঃ Source: National Archives, RG 59, Central Files 1970–73, POL PAK–US. Confidential; Priority; Limdis. Repeated to Islamabad, Karachi, and Lahore.
0 মন্তব্য(গুলি):
Post a Comment